
পারিজাত রহমান নাবিলার দিকে তাকিয়ে আছেন।
নাবিলা নিঃশব্দে কাঁদছে…
বক্স থেকে টিস্যু নিয়ে চোখ মুছলো
কিছুক্ষণ চুপ থেকে এক গ্লাস পানি খেলো…
আপনার বোনেরা এগুলো জানে?
জ্বি জানে, বড় বোন বলে পুরুষ মানুষের জাতই এমন, ফাঁক ফোকর পেলেই নোংরামি শুরু করে, বাসায় সেজে গুজে থাকবি, সুন্দর করে কথা বলবি, বাচ্চাদের দায়িত্ব বাপের হাতে দিয়ে নিজের ক্যারিয়ার গোছানো শুরু কর, সেই কবে গেছিস অস্ট্রেলিয়া, চিকিৎসক হয়েও কিছু করিস না, চাকরিতে ঢুকে যা, আয় শুরু করলেই হাতের মুঠোয় চলে আসবে, হোসেন তো কিপটে আর লোভী, টাকা দেখলেই ভেড়া হয়ে যাবে।
বলেন কেমন লাগে?
জ্বি, মানুষ তার স্বভাব খুব কমই বদলাতে পারে, বুদ্ধিমান মানুষেরা কেবল নিজেদের আপডেট করতে পারে। ধুরন্দররা পারে না, কারণ তারা মনে করেন উনাদের চালাকি কেউ বুঝতে পারে না।
একদিন মেঝো বোনকে খুব সাহস করে বললাম…
আপা আমি দেশে চলে আসি?
আম্মুর ফ্ল্যাটটা তো খালি,
একটা চাকরী নেবো হাসপাতালে, কাজের লোক রাখবো
আমার চলে যাবে দুই বাচ্চা নিয়ে।
মেঝো আপা বললেন তোর মাথা খারাপ?
আত্মীয়-স্বজন কী ভাববে?
তাছাড়া তোর ছেলে অটিস্টিক, বাংলাদেশে স্পেশাল কিডসদের জন্য ভালো স্কুল, চিকিৎসা কিছুই নেই। ওর জন্য হলেও তোর অস্ট্রেলিয়া থাকা উচিত। এছাড়া এত বছর বিদেশে থেকে তোর এখানে ভালো লাগবে না, গরম, বিদ্যুৎ থাকে না, অসহ্য যানজট, বুয়া পাওয়া যায় না ইত্যাদি।
বুঝলাম নিজের দেশ, নিজের বোন, আত্মীয়-স্বজন কেউ নিজের না, সবাই পিঠ বাঁচাতে ব্যস্ত। আপনার জন্য খারাপ লাগছে, আপনি কি আপনার স্বামীর সঙ্গে কখনো খোলাখুলি ঠান্ডা মাথায় কথা বলেছেন তার সমস্যা নিয়ে?
চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু সে তো স্বীকার করে না। মিথ্যা বলে, এড়িয়ে যায়। খুবই চালাক তবে বুদ্ধিমান না, সব কাজেই ফাঁক রেখে দেয়। আমি সবই বুঝি, কিন্তু কী করবো বুঝি না।
জোর গলায় ধরলে ওই যে, আমার দুই পা ধরে কান্না করে নয়তো নিজে থেকেই কান ধরে উঠবস শুরু করে!
আসলেই?
জ্বি, আসলেই! পুরুষমানুষ এত নিচ হয়?
মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে ধরে পিটাই।
ছেলেটার দিকে তাকিয়ে রাগ নিয়ন্ত্রণ করি
কিন্তু নিজের সাথেই নিজের যে যুদ্ধ সেখানে আর পারছি না
হুম, আচ্ছা আপনাকে কিছু প্রশ্ন করি। আবার ভাববেন না তার পক্ষ নিচ্ছি, অনেক সময় আমরা সমস্যার মধ্যে ডুবে থাকলে নিজের দিকটা বা ভূমিকা ভুলে যাই, তিনি আপনার নামে সেগুলো বলছেন অন্যদের সেগুলো কি সত্য?
যেমন আপনি বাসায় খুবই খারাপ আচরণ করেন?
মেজাজ খিটখিটে, ওনাকে বিছানায় জায়গা দেন না ইত্যাদি ইত্যাদি
মাঝে মাঝে মেজাজ খারাপ থাকে, এটা সত্য।
ভালো থাকার তো কোনো কারণ নেই।
কিন্তু বাকিগুলো সত্য না বরং আমার ছেলেকে নিয়ে অনেক ব্যস্ত থাকতে হয়, স্কুলে আনা নেওয়া, গোসল করানো, আমার হাতে ছাড়া খায় না, টয়লেট, ঘুম সবকিছুতেই তো হেল্প করতে হয়, মাঝে মাঝে হাইপার হয়ে যায় তখন তো সামলানোই যায় না…
তবে আমরা তো এক বিছানাতেই ঘুমাই।
আচ্ছা, আপনাদের দু’জনের পারস্পরিক সম্পর্ক কেমন?
ওপরে ওপরে ভালো, কিন্তু আমার তাকে সহ্য হয় না ইদানিং। এত ভন্ড, অথচ দাওয়াতে, কমিউনিটি অনুষ্ঠানে ভালোর ভান করে, অযথা অতিরিক্ত কথা বলে।
আপনি আগে কখনো এই ব্যাপারে অন্য কারো সঙ্গে কথা বলেছেন?
নাহ, শুধু আমার দুইবোন আর এখানের দুইজন পরিচিত ভাবি জানেন, আর আমার জিপি।
জিপি আমার বর্তমান অবস্থা শুনে আপনার সঙ্গে কথা বলতে বলেছেন।
আচ্ছা…
কিছুদিন আগে এক নারী দুপুর বেলা ফোন করে জানালেন, আমার হাসব্যান্ড প্রথমে তাকে ফেসবুকে রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছে, তিনিও বেশ পরিচিত, তো অ্যাকসেপ্ট করেছেন, এরপর হোসেন ইনবক্সে কবিতা লিখে পাঠিয়েছে যে সে তার প্রেমে পড়েছে, তিনি বলছেন আপনার তো স্ত্রী আছে, অন্যের স্ত্রীকে এসব পাঠাচ্ছেন কেন?
তখন সে খুবই অশ্লীল লেখা পাঠিয়েছে। তিনি ব্লক করে দিয়েছেন।
এরপর আর একজন নারী টেক্সট করে পাঠালেন অনেক স্ক্রিনশট, লিখছেন কীভাবে জানি হোসেন তার মোবাইল নম্বর পেয়েছে, এরপর থেকে হোয়াটসঅ্যাপে এসব অশালীন ইঙ্গিতপূর্ণ ম্যাসেজ দিয়েই যাচ্ছেন, তাকে দেখার পর থেকে নাকি হোসেন ঘুমাতে পারছে না রাতে, সারারাত জেগে থাকে, দেখা করতে চান।
আবার রিকোয়েস্টও করছে রাজি না হলে ব্লক করে দেন কিন্তু আমার বউকে কিছু বলবেন না, আমাকে জবাই করে ফেলবে।
আর একদিন একজন সিঙ্গেল মাম ফোন করে বললো। হোসেন তাকে বিয়ে করতে চায়,তিনি রাজি থাকলে আমাকে ডিভোর্স দিয়ে দেবে। তাকে বলছে আমি নাকি অসহ্য নারী, নাক উচা, আমড়া কাঠের ঢেঁকি, কোনো কিছুই পারি না।
শুধু একটা অটিস্টিক ছেলে আছে, যাকে বউ ছাড়া কেউ সামলাতে পারে না, তাই সে আমাকে হজম করছে এতদিন।
চিন্তা করেন তার ভণ্ডামি? সমাজের সবাই তো এক রকম না। তারা তাও আমাকে বলছে, কীভাবে আমার নম্বর পেয়েছেন জানি না, অনেকেই হয়তো হোসেনকে ব্লক করে বসে আছেন, আমি পর্যন্ত আসেননি, আবার অনেকেই হয়তো হোসেনের মতো, দেখা করে। সময় কাটায়। আমি হয়তো কিছুই জানি না।
এ রকম একটা লোকের সঙ্গে কতক্ষণ ভালো ব্যবহার করা যায়?
জ্বি, আমি বুঝতে পারছি। খুবই দুঃখজনক, আপনি এখন কি করতে চান?
আমি কিছুতেই তার সঙ্গে থাকতে চাই না, সে তার পি এইচ ডি ভেজে খাক, তার ডায়াবেটিস আছে, মাথায় টাক পড়ছে,
দেখতেও ভালো না, ধর্ম কর্ম করে না, অথচ জুম্মার দিন মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়ে মোনাজাতের সময় কান্নাকাটি করতে করতে শুয়ে পড়ে, বলে আল্লাহ আমার একটাই ছেলে ভালো করে দাও। পাশে বসে থাকা ভাই গুলো থামায়। এক ভাবি একদিন আমাকে এই ঘটনা বললেন।
বলে ভাইয়ের মনে অনেক কষ্ট!
আমি কি বলবো বুঝি না,
আমার কিছুতেই এত অসম্মানের জীবন ভালো লাগে না,
সবাই আমাকে নিয়ে আড়ালে হাসে…
শুধু ছেলেটার জন্য আটকে যাই
কেন?
সে যখন হাইপার হয়ে যায়, আমি পারি না, হোসেনের সাহায্য লাগে।
শুধু এই কারণে আপনি ওনার সঙ্গে থেকে যেতে চান?
কি করবো?
মায়েদের যে বেহায়া হতে হয়..
দেখুন আপনি কী করবেন এটা আপনার সিদ্ধান্ত, তবে মানসিক অশান্তি শারীরিক সমস্যার চেয়েও খারাপ, এই অশান্তি দিন দিন আপনাকে শারীরিক ভাবেও অসুস্থ করে ফেলবে। আপনার দুটো ছোট বাচ্চা আছে। এমন যন্ত্রণার জীবনে আসলেই সীমাহীন কষ্টের।
জ্বি, কিন্তু আমি কি একা এই দুই বাচ্চা নিয়ে অস্ট্রেলিয়ায় থাকতে পারবো?
কেন নয়?
আপনি তো অস্ট্রেলিয়ার সিটিজেন, আপনাকে সেন্টারলিঙ্ক সাপোর্ট দেবে যতদিন চাকরি না পাচ্ছেন, এরপর আপনার যেহেতু স্পেশাল কিডস আছে, আপনার ছেলেকে এন ডি আই এস. সাপোর্ট দেবে, দরকার লাগলে বাসায় সাপোর্ট ওয়ার্কার দেবে, আপনার সারকামটেন্সেস এসেস করেই ওরা আপনার ছেলের ফান্ড অ্যাপরুভ করবে।
এখানে প্রতিটা মানুষকে মানুষ হিসেবে মূল্যায়ন করা হয়, স্বাভাবিক ভাবে বেঁচে থাকা প্রতিটি নাগরিকের অধিকার।
আচ্ছা আমি তাহলে একটু চিন্তা করি…
অবশ্যই, চিন্তা করুন
আপনার হাসব্যান্ড রাজি হলে ওনাকে নিয়ে আসুন।
বলে দেখবো, মনে হয় না আসবে
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে
আমার জন্য দোয়া করবেন, আমি যেনো এই কারাগার থেকে বের হতে পারি।
আপনাকেও ধন্যবাদ এখানে আসার জন্য।
নাবিলা হক মন মরা হয়ে চলে গেলেন।
পারিজাত রহমান উঠে গিয়ে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন,
নিজের অজান্তেই দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো।